আমারো পরাণো যাহা চায়
বাবা আমাকে দুটো জায়গার অপ্শন
দিয়েছিলেন। ডারবান অথবা কলকাতা। আমি কলকাতা বেছেছিলাম। অনেকদিন পর আমি আমার মনের কথা শুনেছিলাম। মনে হচ্ছে, দ্বীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ভগবান
আমার স্বপ্ন পূরন করেছেন। রাতের নিস্তব্ধতা চারিদিকে এখন। পাশের জানালা দিয়ে চাঁদের আলো এসে ঢুকছে আমার ঘরে। আজ প্রায় কুড়ি বছর পর কলকাতা
শহরে প্রথম রাত আমার। আমার বাংলার ব্যাপারই আলাদা। ঘুম আসছে না কিছুতেই। মানুষ যখন খুব খুশি হয়, তখন বোধহয় এমনটিই হয়। আসলে গ্ল্যাসগোতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। স্কটিশদের
ভীড়ের মাঝে নিজেকে ভীষণ বিচ্ছিন্ন লাগতো। মনে হতো আমি কারাবাসে আছি। মা বাদ দিয়ে
বাবা আর দাদা নিজেদেরকে আপাদমস্তক ইংরেজ বানিয়ে নিয়েছে। আমার ভাল লাগতো না ওসব
কিছুই, কলকাতার জন্য মন কেমন করতো।
বাবার উপর আমার আর মায়ের অনেক
ঋণ আছে। উনি আমাদের জীবনকে সামলে দিয়েছেন। জন্মের আগেই আমার নিজের বাবা মারা
গিয়েছিলেন। উল্টডাঙায় দাদুর বাড়িতে থাকতাম। মা এক গানের স্কুলে বাচ্চাদের গান
শেখাতো। ভর্তি হয়েছিলাম উল্টডাঙা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তারপর মায়ের এক বন্ধবীর মামাতো
ভাইয়ের সুবাদে মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে বিস্ত্রীক এক ধনী বাঙালীর সাথে। থাকেন গ্ল্যাসগোতে। আমার চেয়ে একটু বড়
ওনার একটা ছেলেও আছে। সেই থেকে বাবা-মার কছে ছিলাম বিদেশে। আর বুকের মধ্যে বয়ে বেড়াচ্ছিলাম শিকড় ছেঁড়ার এক
যন্ত্রণা।
বাবার একটা মিউজিক কম্পানী আছে।
বেশ বড়। বিস্তৃত করেছেন ওনার বিজনেস পৃথিবীর অনেকগুলো শহরে। দেশের প্রতিষ্ঠীত এবং
বিখ্যাত গায়কদের গান রিমিক্স করে আমাদের কম্পানী। বাবা আর দাদা মিলে ব্যবসাটা ভালই চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু আমি বুঝতে পারি না এর কিছুই। আমার উপর দায়ীত্ব দিয়ে বাবা
আমায় শিখিয়ে চলেন সবসময়। কিছুদিন যাবৎ ওনার ডারবান আর কলকাতার প্রজেক্টটা ভাল চলছিল না। পরপর তিনটে অ্যালবাম ফ্লপ হয়েছে। তাই বাবা আমায় কলকাতা পাঠিয়েছেন, এখানকার বিজনেস সামলানোর জন্য। আমি কোনো প্রশ্ন না করে চুপুচাপ চলে এসেছি এখানে।
গ্ল্যাসগোতে মা ইন্ডিয়ান স্কুল
অফ মিউজিকে শিক্ষকতা করে। রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখায় ওখানকার বাঙালীদের। খুব স্বাভাবিক
ভাবেই মা রবীন্দ্রনাথকে তার ঠাকুর হিসেবে মেনে নিয়েছে। মায়ের ঘরে রবী ঠাকুরের এমন কোনো বই নেই যা উনি পড়ে নি। বিদেশের মাটিতেও বাংলাকে
বাঁচিয়ে রেখেছে মা। মায়ের কাছ থেকে কিছুটা অভ্যাস আমিও পেয়েছি। সময় পেলেই কবিতা,
গল্প কিম্বা রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে সময় কাটাই।
এক সপ্তাহ হয়ে গেছে কলকাতায়
এসেছি। অফিসের কোনো কাজ করি নি। করার ইচ্ছাই নেই। তিলোত্তমা কলকাতাকে ভাল করে দেখার
ইচ্ছা করছে একবার। গঙ্গার পাড়, প্রিন্সেপঘাট, ভিক্টোরিয়া, হাওড়াব্রীজ, দক্ষিনেশ্বর,
নন্দন, একাডেমী, ময়দান, ধর্মতলা সব ঘুরেঘুরে বেড়াচ্ছি এখন। উল্টডাঙায় আমার স্কুলে
গিয়েছি একবার। বদলে গেছে সবকিছু, ছোট্ট স্কুল এখন দুতলা হয়ে গেছে। আমার ছেলেবেলাকে
দেখে এসেছি আরও একবার।
বাবার পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের
পরবর্তি বাংলা অ্যালবাম রিলিজ হবে এইমাসেই। রবীন্দ্রসঙ্গীতকে রিমিক্স করে। সামনেই আসছে পঁচিশে বৈশাখ। তার
আগেই যাবতীয় সব কাজ সেরে অ্যালবাম মার্কেটে ছাড়তে হবে। অফিসের সবাই ধুমধাম কাজ
শুরু করে দিয়েছে আমার আদেশ অনুযায়ী। অনেক বেশী টাকা দিয়ে এইবার নামী এক গায়ককে
মনোনীত করা হয়েছে। সফল আমাদেরকে হতেই হবে। স্টুডিওতে সকলেই ব্যস্ততার সাথে কাজ
করছে এখন। শুধু আমি চলেছি আমার গতিতে। কিছু পূরানো বন্ধু-বান্ধবদের সাথে প্রতিদিন
আড্ডা মারছি কফিহাউসে বসে। বাংলা নাটক দেখছি গিরিশ মঞ্চে। কলেজস্ট্রিটের গলিতে
ঘুরে ঘুরে রবী ঠাকুরের বই কিনছি। রাতে বাবা-মাকে ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি, ‘আমি ভাল
আছি এখানে’।
বিশ্বভারতীর কপিরাইট শেষ হয়ে
যাওয়ার পর, রবীন্দ্রসঙ্গীতকে নিয়ে কাটাছেঁড়া শুরু হয়েছে অনেকদিন আগে থেকে। নতুন
জেনরেশনের সামনে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে নতুন সুরে, নতুন রুপে তুলে ধরার অপচেষ্টায় আর
কারও আপত্তি না থাকলেও আমার আপত্তি আছে। বাবা আমার কথা শোনেন নি। আমাদের অ্যালবাম
তৈরী। সামনের সপ্তাহে রিলিজ হবে।
কয়েকদিন পর পঁচিশে বৈশাখ। খুব গরম পড়েছে। কলকাতার
আবহাওয়ায় একটু অসুবিধা হচ্ছে বটে। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। প্ল্যান অনুযায়ী হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে গেলাম সকাল সকাল। আজ
বোলপুর যাবো। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে। কখোনো দেখি নি আমি। অনেকদিনের ইচ্ছা
ছিল। হাওড়া থেকে সকাল দশটা চল্লিশে ছাড়ে কবিগুরু এক্সপ্রেস। জানালার ধারে একটা সিট
নিয়ে বসে পড়লাম। কলকাতার বাস-ট্রাম-ট্রেন-রিক্সা বেশ ভালই লাগছে। ধিরে ধিরে ট্রেনে
ভীড় বাড়তে থাকলো। আমি দেখছি জানালার বাইরে আমার সোনার বাংলাকে। ভীড়ের
মাঝে আমাদের কামরায় ঘুরে ঘুরে ফিরছে কতকিছুর ব্যাপারী। মশলামুড়ি, বাদামছাপা, টাইগার বাম, আমলকি
কিম্বা লেবু লজেন্স। সবাই নিষ্ঠার সঙ্গে করে চলেছে
তাদের ব্যবসা। আমিও তো করছি একটা ব্যবসা। সঙ্গীতের ব্যবসা। কিন্তু পারছি না কেন।
ধিরে ধিরে ট্রেন একটু খালি হতে
থাকলো। বোলপুর আসতে আর বেশি বাকি নেই। হঠাৎ আমার কানে আসছে এক রবীন্দ্রসঙ্গীতের
আওয়াজ। কেউ গাইছে। ক্রমশ্য আওয়াজটা আরো স্পষ্ট হতে থাকলো। খালি গলায় এমন সুন্দর রবীন্দ্রসঙ্গীত
আমি আগে শুনি নি কখোনো। অসাধারন কন্ঠস্বরে গাইছে লোকটা-
আমার পরান
যাহা চায়...তুমি তাই,
তুমি তাই গো...
তোমা
ছাড়া আর এ
জগতে...মোর কেহ
নাই,
কিছু নাই গো...
আমার পরান
যাহা চায়... তুমি তাই,
তুমি তাই গো...
লোকাটা আমারদের কামরায় এসে
পৌঁছালো। তাকিয়ে দেখলাম মধ্যবয়স্ক একটা লোক। ভিক্ষে করছে। ডান হাতটা কাঁধের কাছ থেকে কাটা। বাম
হাতে একটা পাত্র। সবাই পয়সা দিচ্ছে তাতে। আমি পটেক থেকে একটা দশ টাকার
নোট লোকটার বাটিতে রাখলাম। একবার আমার দিকে তাকালো সে। তারপর পুরো গানটা গাইতে
গাইতে সামনের কামরার দিকে চলে গেলো। আমি কিছুক্ষণের জন্য চুপচাপ হয়ে গেলাম। মাথার
মধ্যে সেই অবাক করা ঝড়টা চলছে এখনও। বিনা চর্চায়, বিনা রেওয়াজে একটা মানুষের গলা
এত ভাল কি করে হতে পারে। দুরের কামরা থেকে এখনও আওয়াজ আসছে-আমার পরান
যাহা চায়....।
কিছুক্ষণ পর বোলপুর এসে গেলো। আমি নেমে পড়লাম। স্টেশনের
চায়ের দোকানে মাটির ভাঁড়েতে চায়ে চুমুক দিলাম একটা। হঠাৎ সামনের বেঞ্চটাতে চোখ
গেলো, দেখলাম সেই হাতকাটা ভিখারীটা বসে আছে। গিয়ে বসলাম ওর পাশে। নাম জিজ্ঞেস
করলাম। কথা বললাম অনেকক্ষণ ধরে। তারপর একটা ট্রেন আসতেই লোকটা চলে গেল। আর আমি
চললাম শান্তিনিকেতনের পথে।
আমাদের রবীন্দ্রসঙ্গীতের রিমিক্সড
অ্যালবাম যথারীতি রিলিজ হয়ে গেছে গত সপ্তাহে। বাবার কম্পানীর মুখ রক্ষা করার তাগিদ
আমার। কিন্তু যা হবার তাই হলো। যাদের শোনার তারা শুনলো, বাকিরা নিলো মুখ ফিরিয়ে।
সমালোচনা হলো, খবরের কাগজের হেডিং হলো। আর তার সাথে হলো বাবার পয়সা ধংস্ব। আরও
একটা ফ্লপ অ্যালবাম। আমার কপালে জুটলো তিরস্কার। দাদা ফোনে বোঝালো প্রোডাক্ট
মার্কেটিংএর স্ট্র্যাটেজি। আমি ওদেরকে কি’করে বোঝাই, বিজনেস আমার দ্বারায় যতটুকু
হয় আমি ঠিক ততটুকুই করতে পারি। তার বেশি নয়।
আজ সারাদিন শুধু ভেবেছি।
বাবা-মার কথা ভেবেছি। দাদার কথা ভেবেছি। কলকাতায় আমাদের মিউজিক কম্পানীর কথা
ভেবেছি। বাবা এখনও হাল ছাড়েন নি। পরের অ্যালবামের কাজ আমার নিজের পছন্দের উপর ছেড়ে দিয়েছেন।
কলকাতায় পার্মানেন্টলী থাকা এবং নিজেকে প্রমান করার একটা শেষ চেষ্টা আমার করা
উচিত। এবারের অ্যালবাম হবে আমার পছন্দের গায়কের সাথে। সারারাত মাথার মধ্যে এক
অদ্ভুদ প্ল্যান ঘুরছিল। সকাল হতেই জানি না কেন, হাওড়া স্টেশনে গিয়ে বসে পড়লাম
কবিগুরু এক্সপ্রেসে। কোনো একজনের জন্য উদ্বিগ্ন অপেক্ষায় জানালার ধারে বসে থাকতে
থাকতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝতে পারি নি। হঠাৎ ঘুম ভাঙলো সেই গানের আওয়াজে- আমারো পরানো যাহা চায়...তুমি তাই,
তুমি তাই গো...
------সমাপ্ত------